প্রচ্ছদ » সারাদেশ » পাহাড়ে শিবিরের গোপন প্রশিক্ষণ নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ খাগড়াছড়ি–রাঙামাটি
পাহাড়ে শিবিরের গোপন প্রশিক্ষণ নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ খাগড়াছড়ি–রাঙামাটি
বিশেষ প্রতিবেদনঃ 17 December 2025 , 4:02:58প্রিন্ট
সংস্করণ
জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চলে জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামী ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গোপন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য সামনে আসছে। এ নিয়ে ক্রমেই প্রশ্ন ও উদ্বেগ বাড়ছে। একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির কিছু এলাকায় সংগঠিতভাবে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালানো হয়েছে।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও গুইমারা উপজেলায় স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ের ভেতরে দলবদ্ধভাবে তরুণদের অবস্থান ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম তাদের নজরে আসে। যদিও রাঙামাটিতে নির্দিষ্ট কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র শনাক্ত করা যায়নি, সীমান্তবর্তী এলাকায় শিবির সংশ্লিষ্ট একটি দলের তৎপরতার তথ্য মিলেছে।
একাধিক সূত্রের দাবি, প্রশিক্ষণগুলো সাধারণত ১৫ দিনের এবং প্রতিটি ব্যাচে ৬০–৭০ জন অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারীরা সুঠাম দেহের অধিকারী এবং অধিকাংশের উচ্চতা প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি। তাদের শারীরিক সক্ষমতা, শৃঙ্খলা এবং গোপনীয়তা রক্ষার কৌশল স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার ও আগ্রাসী মনোভাব
গুইমারা এলাকায় প্রশিক্ষণ নেওয়া এমনই একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় প্রতিবেদকের। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ‘রাহাত’ (ছদ্মনাম) নামে তিনি কথা বলেন। তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার, ১৯৭১-কে “গন্ডগোল” ও “ষড়যন্ত্র” হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের প্রতি চরম বৈরিতা স্পষ্ট। তার ভাষা ও আচরণে আগ্রাসী আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করা গেছে, যা মানবাধিকারকর্মী ও স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
প্রকাশ্য পদ নেই, কিন্তু ছায়া কাঠামোর ইঙ্গিত
তথ্য অনুযায়ী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অনেকেই জামায়াত বা শিবিরের কোনো প্রকাশ্য সাংগঠনিক পদে নেই। তবে তারা আদর্শগতভাবে অত্যন্ত কট্টর এবং সংগঠনের মূল বয়ানের প্রশ্নে কোনো আপস করতে রাজি নয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি ‘শ্যাডো নেটওয়ার্ক’ বা ছায়া কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়, যা প্রয়োজনে সক্রিয় করা হতে পারে।
আরও প্রশ্ন তুলেছে পুরনো ও অভিজ্ঞ ক্যাডারদের নতুন করে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার বিষয়টি। একজন ব্যক্তি, যিনি বহু আগে থেকেই অস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী বলে পরিচিত, তিনিও সম্প্রতি ১৫ দিনের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে করে প্রশিক্ষণের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
তিনটি গুরুতর আশঙ্কা
পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের পেছনে তিনটি সম্ভাব্য উদ্দেশ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে—
এক. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও চেতনার অনুসারীদের গুপ্ত উপায়ে ভীত করা বা নির্মূলের চেষ্টা।
দুই. ডানপন্থী রাজনীতির বিরোধী বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল চিন্তক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের টার্গেট করা।
তিন. গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার পক্ষে থাকা রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীদের দমন।
আঞ্চলিক নিরাপত্তার ঝুঁকি
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সংবেদনশীল অঞ্চল, যেখানে সীমান্ত, জাতিগত বৈচিত্র্য ও অতীত সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। এই অঞ্চলে যেকোনো গোপন সামরিক বা আধাসামরিক প্রস্তুতি শুধু জাতীয় নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
একজন সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন,
“পার্বত্য এলাকায় সংগঠিত প্রশিক্ষণ হলে সেটি নজরদারির বাইরে থাকার ঝুঁকি থাকে। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের তৎপরতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অশুভ ইঙ্গিত।”
এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্লেষক ও সচেতন মহলের অভিমত, জাতীয় নিরাপত্তা, মানবাধিকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং নির্বাচনকালীন শান্তি নিশ্চিত করতে এসব তথ্য অবিলম্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা জরুরি।